জ্বরঠোসা কি? জ্বর ঠোসা হওয়ার কারণ, সারানোর উপায়
মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে আমাদের ঠোঁটের কোনায় বা ভিতরের দিকে কিংবা অনেক সময় নাকের কাছে ফুুসকুড়ি ও সাথে সামান্য ব্যথা অনুভব করি। সাধারণত এটাকেই আমরা বলে থাকি জ্বর ঠোসা।এটাকে অনেকেই অনেক নামে চেনেন ,তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান এটাকে বলে থাকে ফিভার ব্লিস্টার।
এই জ্বর ঠোসা বেশিরভাগ মানুষের কাছে খুব পরিচিত একটা বিষয় ।তাই এটাকে কেন্দ্র করে রয়েছে অনেক ধারণা। তবে বেশিরভাগ মানুষ মনে করে জ্বর আসলে জ্বর ঠোসা হয় । জ্বরঠোসা যে অনেক বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে সেটা আমরা অনেকেই জানিনা বিধায় এটাকে হেলাফেলা করে থাকি। তাই আমরা আজ এই জ্বরঠোসা হওয়ার কারণ ও প্রতিকার এবং সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।
জ্বর ঠোসা হওয়ার কারণ কি
জ্বর আসলে জ্বর ঠোসা হয় এই ধারণা অনেকের মধ্যে আছে তবে এই ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। এই রোগের প্রধান কারণ হচ্ছে ভাইরাস। যার নাম এইচ এস ভি ওয়ান ।এই ভাইরাসের ইনফেকশনের কারণে মূলত আমাদের শরীরে জ্বর আসে ।তবে জ্বরের কারণে বা অন্য কোন ইনফেকশনের কারণে যদি আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায় তাহলে জ্বরঠোসা হতে পারে।
জ্বরঠোসা যাদের বেশি হয়
চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় ৮০% মানুষই HSV-1 এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। তবে এই ভাইরাস মানব দেহে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১০ বছর বয়স হলে প্রথমবার প্রকাশ ঘটে ।জ্বরঠোসা হয়ে সেরে গেলেও এই ভাইরাস মানবদেহে লুকিয়ে থেকে বারবার নিজের প্রকাশ ঘটাতে পারে ।যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বিশেষ করে বৃদ্ধ ও নবজাতক কিংবা নানা বিধ রোগে আক্রান্ত মানুষের এটা বেশি হয়ে থাকে।
ঘনঘন প্রকাশ পাওয়ার কারণ
মানবদেহে আগে থেকেই কোন ইনফেকশন থাকলে।
অতিরিক্ত মানসিক চাপ থাকলে ।
দেহের কোথাও আঘাত পেয়ে যদি ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে।
জ্বরঠোসা ছড়ানোর কারণ
এই ভাইরাসে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। জ্বরঠোসার ভেতরের তরল যদি ফেটে গিয়ে আশেপাশে লেগে যায় তাহলে বেশি ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তি জ্বর ঠোসার তরলে হাত দিয়ে সেই হাত না ধুয়ে যদি অন্য কোথাও স্পর্শ করে।
দ্রুত সংক্রমণ ছড়ানোর কারণ গুলো
হাত দিয়ে জ্বর ঠোসা স্পর্শ করে ওই হাত দিয়ে দেহের অন্য ক্ষতস্থান স্পর্শ করলে।
জ্বরঠোসার ফুসকুড়ি গলে গিয়ে তরল ছড়িয়ে পড়লে।
জ্বরঠোসায় আক্রান্ত ব্যক্তির গ্লাস বা চামচ লিপস্টিক বা অন্যান্য কিছু ব্যবহার করলে।
জ্বর ঠোসা কোথায় হয়
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে , ঠোঁটেই হয় তবে আশেপাশেও হয় ।ক্ষতস্থান ,নাক ,চোখের কাছে হতে পারে ।মূলত এই ভাইরাস যেখানে লাগবে সেখানে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
জ্বরঠোসা ছোঁয়াচে থাকে কতদিন
জ্বরঠোসা ওঠার পর সেখানে যখন থেকে ব্যথা ও চুলকানি শুরু হয় তখন থেকেই এটি ছোয়াচে। যতদিন পর্যন্ত এটি সম্পূর্ণরূপে সেরে না যায় ততদিন এই জ্বর ঠোসা ছোঁয়াচে ।তবে তখন ফুসকুড়ির ফেটে তরল বের হয় তখন এটি সবচেয়ে বেশি ছোঁয়াচে হয়।
জ্বর ঠোসা হওয়ার লক্ষণ
ঠোটে ব্যথা ও সাথে চুলকানি হওয়া।
ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া এবং ফুসকুড়ির ভেতরে তরল থাকবে।
জ্বরঠোসা হলে গায়ে জ্বর থাকতে পারে সাথে অন্যান্য লক্ষণও থাকতে পারে।
বমি হতে পারে কিংবা বমি বমি ভাব হতে পারে।
খাবারে প্রতি অরুচি হওয়া।
অনেক ক্ষেত্রে মাথা ব্যথা হতে পারে।
জ্বরঠোসার কারণে সৃষ্ট জটিলতাগুলো
চোখের সমস্যা অর্থাৎ কর্নিয়ার সংক্রমণ হতে পারে।
প্রজনন তন্ত্রে ইনফেকশন হতে পারে।
বয়স্ক মানুষের আলজেইমার নামক রোগ হতে পারে।
শিশু মৃত্যু ঘটাতে পারে।
সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ ঘটতে পারে।
জ্বরঠোসা চেনার উপায় গুলো
জ্বরঠোসাকে মূলত আমরা খালি চোখে দেখেই চিনতে পারি ।তবে ভাইরাস শনাক্ত করতে হলে জ্বর ঠোসাা তরল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে হয়। কারণ খালি চোখে ভাইরাস দেখা যায় না।
জ্বরঠোসা হলে করণীয়
জ্বরঠোসা হয় এবং কিছুদিন পর তার নিজের থেকেই সেরে যায় তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে জ্বর ঠোসা খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে পারে যেমন টক দই ,চিজ, মাছ জ্বর ঠোসা তাড়াতাড়ি সারিয়ে তোলে কারন এগুলোতে অ্যামিনো এসিড এল লাইসিন রয়েছেন। বেশি পরিমাণে ক্ষারীয় খাবার গ্রহণ করা। বাদাম ,বীজ জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া ।জ্বরঠোসা হলে নারকেল তেল অথবা ট্রি অয়েল ব্যবহার করা। জ্বর ঠোসা আক্রান্ত হলে শিশুদের চুমু দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। জ্বরঠোসা কোনোভাবেই হাত না দেওয়া। এ ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহারের জিনিসপত্র আলাদা করা ।নিয়মিত আক্রান্ত স্থানে বাম বা অন্য কোন ঔষধ ব্যবহার করা। তবে অবশ্যই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা পরিহার করতে হবে।
জ্বর ঠোসা প্রতিরোধ করার উপায়
অনেকেই আছে যারা একবার নয় একাধিকবার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তাই কিছু সচেতনতা তৈরি করে এই সংক্রমণ কমানো সম্ভব।
আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিস ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।
জ্বরঠোসায় হাত লাগলে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলা।
চুম্বন ও ওরাল সেক্স থেকে বিরত থাকা।
দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।
দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকার চেষ্টা করা।
চোখে হাত না দেয়া।
নবজাতক ও বয়স্ক মানুষ হতে দূরে থাকা।
মারাত্মক আকার ধারণ করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে জ্বর ঠোসা সারানোর উপায়
মধু - জ্বর ঠোসায় মধু খুব ভালো প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে থাকে।তাই দিনে দুইবার ক্ষতস্থানে মধু লাগান ।তবে মধু ও আমলকি গুঁড়ো মিশিয়ে লাগালে ভালো ফল পাওয়া যায়।
নারিকেল তেল- নারিকেল তেলে আছে ট্রাইগ্লিসারাইডস। যা ভাইরাস মারতে পারে ।তাই ক্ষতস্থানে বারবার এটির লাগালে ভালো উপকার পাওয়া যায়।
রসুন- রসুনের অনেক উপকারী গুণ রয়েছে ।তাই জ্বর ঠোসা প্রতিকারেও রয়েছে রসুনের ভূমিকা রসুন কুচি করে ক্ষতস্থানে দিনে দুই থেকে তিনবার লাগান।তবে যদি রসুন খেতে পারেন তাহলে আরো ভালো হয়।
আইস কিউব- আইস কিউব ঘায়ের ফোলা অংশে ধরলে ফোলা ভাব ব কমে যায় এবং দ্রুত সারতে সাহায্য করে।
দুধ- দুধ নানাবিধ গুন সম্পন্ন একটি তরল খাবার। নানা গুণের মধ্যে একটি হচ্ছে দুধ জ্বর ঠোসা নিরাময়ের কাজ কর দুধে আছে অ্যান্টিভাইরাল প্রোপার্টি যা ক্ষত সারাতে দ্রুত কাজ করে ।তাই দুধ ক্ষতস্থানে লাগানো ভাল
অ্যালোভেরা- জ্বর ঠোসায় অ্যালোভেরার রস লাগালে দ্রুত ফল পাওয়া যায় কারণ অ্যালোভেরাই জ্বালাপোড়ার প্রদাহ কমানোর ক্ষমতা আছে।
জ্বর ঠোসার আধুনিক চিকিৎসা
জ্বর ঠোসা নিরাময়ে পূর্বে কোন চিকিৎসা না থাকলেও বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় জ্বরঠোসা হলে বাজারে কিছু ক্রিম বা মলম পাওয়া যায় ।এই ক্রিমগুলো জ্বর ঠোসা তাড়াতাড়ি ভালো করতে সাহায্য করে।
জ্বর ঠোসায় মলম- এই চিকিৎসায় অ্যান্টিভাইরাল ক্রিম (যেমন এসাইক্লভির) এর ব্যবহার করা যেতে পারে।দিনে চার থেকে পাঁচ বার ব্যবহার করলে জ্বর ঠোসা সেরে যায়।
ব্যাথা নিরাময় করার মলম- জ্বরঠোসায় অতিমাত্রায় ব্যথা অনুভব করলেন লিডোকেইন জাতীয় জেল ব্যবহার করা যেতে পারে ।এই জেল ব্যবহার করলেন ব্যথা থেকে উপশম পাওয়া যায়।
জ্বর ঠোসাই প্যারাসিটামল- জ্বর ঠোসাই ব্যথা, ফোলা বা জ্বরের চিকিৎসায় প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যেতে পারে ।বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়ানো যাবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য - নবজাতক ও শিশু ,গর্ভবতী নারী কিংবা কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল কিংবা মারাত্মক জ্বর ঠোসা হয়েছে এমন রোগীদেরকে হাসপাতালে নিতে হতে পারে।
তাই সচেতন থাকুন সুস্থ থাকুন।
Post a Comment